বোহেমিয়ানঃ ৩য় পর্ব
লেখা: ফারজানা সাদিয়া অনন্যা
হঠাৎ কোথা থেকে এসে শুভ্র পেছন থেকে বলে,
যুথি তোমার যদি ভয় কাটে তোহ এক কাপ চা খেতে পারো আমার সাথে।
যুথি মৃদু চমকে পেছনে তাকাই দেখে শুভ্র দু কাপ চা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
কই আমি ভয় পাইনি তোহ।
আচ্ছা ভয় পাওনি কিন্তু ভীত হয়েছিলে ঠিকই।যাই হোক চা খাবে আমি কিন্তু দু কাপ চা বানিয়েছি।
শুভ্র চায়ের কাপ যুথির দিকে এগিয়ে বলে বসুন।
যুথি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সোফায় বসে চায়ের কাপে ঠোঁট ডুবাই।
শুভ্র তুমি তোহ অসাধারণ চা বানাও।
ধন্যবাদ।চায়ের সাথে আর কিছু নেবে?যেমন সিগারেট বা অন্য কিছু।
আচ্ছা তুমি আমাকে বার বার সিগারেট কেনো সাধছো?
আমার বারবার মনে হয়েছে তুমি মাঝে মধ্যে সিগারেট খাও।লজ্জা না করে নিতে পারো একটা সিগারেট।
খেয়েছি অনেক আগে এখন ইচ্ছা করছে না।কিন্তু তুমি সব বুঝে যাও কি করে?
ম্যাজিক।আচ্ছা তোমার ঘুম পাচ্ছে না!সারারাত জেগে তুমি।
ম্যাজিক না ছাই।আপাতত পাচ্ছে না চায়ে ঘুম কেটে গেলো।
আচ্ছা তবে তুমি লাইব্রেরি রুমে গিয়ে বই পড়তে পারো আমার মাঝ রাতে চা সিগারেট খাওয়ার পরে প্রচন্ড ঘুম আসে।
এমন কেনো? মানুষ রাত জাগার জন্য চা সিগারেট খাই আর তুমি ঘুমের জন্য?অদ্ভুত!
জগতের সব কিছুর বোধ হয় আমার প্রতি বিতৃষ্ণা তাই আকর্ষিত না হয়ে বিকর্ষীত হয়।
তোমার এমন কেনো মনে হয়?
সব কেনোর উত্তর হয় না যূথি।বা সব কেনোর উত্তর,উত্তর কর্তা নাও দিতে পারে।উত্তর আসবে কি আসবে না তা সম্পূর্ণ ডিপেন্ড করে উত্তর কর্তার ওপর।
সেই দিক বিবেচনা করলে আমি উত্তর দিতে চাচ্ছি না।
তুমি এমন কেনো শুভ্র!
আমি এমনই।তোমার জন্য কিছু ছিলো বলে শুভ্র পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ যুথির দিকে এগিয়ে দেয়।
কি এটা?
কাগজটা দিলাম প্রশ্ন না করে খুলে দেখো।তোমরা উত্তর হাতে থাকতেও প্রশ্ন ছুঁড়বে কেনো? অদ্ভুত!
ওকে খুলছি খুলছি।
কাগজ খুলে দেখে যুথির নিজের মুখমণ্ডল এর ছবি নিখুঁতভাবে আঁকা হয়েছে।
ওখানে বসে ছবি আঁকছিলে এটা সেই কাগজটা না?
হুম।
অনেক ধন্যবাদ।
যুথি তুমি কাল একটা শাড়ি পরো তোহ সাদা রঙ এর শাড়ি।
যুথির উত্তর না নিয়েই শুভ্র চলে গেলো নিজ ঘরে।কারণ শুভ্র জানে যূথি শাড়িটা পরবে।
বিকেল বেলায় শুভ্রের দরজায় সুক্ষ্ম টোকা দিচ্ছে কেউ শুভ্র চোখ মুছে দরজাটা খুলে হতভম্ব।
যূথি শাড়ি পরে এসেছে।ভীষণ অপূর্ব লাগছে যূথিকে।
এ আমি কাকে দেখছি মিস যূথি নাকি!
চা ধরো আমার হাত লেগে গেলো।
এখন ডাক দিলে যে?
আর কত ঘুমাবে?কয়টা বাজে দেখেছো?
আমি তোহ সন্ধ্যায় উঠি।
এখন এতো ঘুমালে চলবে না।আমি তোহ তোমার সাথে ঘুরতে যেতে চেয়েছিলাম।
শুভ্র চায়ে চুমুক দিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো।যূথি এসে পর্যন্ত এই রুমটাই শুধু ঢোকেনি।পুরো রুমটা সিগারেট এর ধোঁয়া আর ভাপসা গন্ধে ভরা।
দক্ষিণ দিকের জানালা খুলতে খুলতে যূথি বলে দক্ষিণমুখী ঘর নিয়ে কি লাভ যদি জানালায় না খোলো!
শুভ্রের কোনো প্রতিক্রিয়া এলো না।
জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড় বহুদূরে মনে হচ্ছে একটা পানির ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে।
শুভ্র ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই যূথি প্রশ্ন করে আচ্ছা চা কেমন হয়েছে বললে না তোহ!সত্যি করে বলবা কেমন হয়েছে।
ভালো।
শুধু ভালো?
ভালো তবে সুবলদা এর চায়ের মতো ওতো সুন্দর না।
যূথির মুখটা মলিন হয়ে গেলো।
দেখেছো যূথি তুমি সত্যি বলতে বলে আবার নিজেই মুখটা মলিন করে বসে আছো।
দেখো যূথি আমি অতিরিক্ত প্রশংসা করতে একদম অপছন্দ করি।জানো তোহ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো নয়।
বাহিরে চলো।
হুম,তবে আমার একটা শর্ত আছে।
কি শর্ত?
তুমি গাড়ি নিতে পারবে না আমার সাথে হাঁটতে হবে।
ঠিক আছে আমি রাজি।
রাস্তায় হাঁটছে দুজন সবুজ পাঞ্জাবী পাশে সাদা শাড়ি অসাধারণ লাগছে।মনে হচ্ছে প্রকৃতির সবুজ আর মেঘের অসাধারণ সমীহ গড়ে উঠেছে।
এক পুলিশ অফিসার পেছন থেকে ডাক দেয় শুভ্র সাহেব।
পেছনে তাকিয়ে জ্বি মোকাদ্দেস সাহেব বলুন।
আপনার পাগলামি কি কমেছে?
না।
মেয়েটি কে শুভ্র সাহেব?
আমি তার পরিচয় দিতে ইচ্ছুক নই।
আপনার পাগলামি কি কোনোদিন কমবে না?
দেখেন আমার দিক থেকে মনে হয় আমি ঠিক।বলে শুভ্র হাঁটা শুরু করে।
পুলিশ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে যত্তসব নিজেকে কি ভাবে কে জানে!
আচ্ছা উনি কি বলছিলেন পাগলামি না কি?
তোমার যদি এতোই কৌতূহল থাকে তুমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে নিতে পারো।
নাহ চলো।
অনেকটা পথ দুজন হেঁটেছে আজ দেখেছে সুন্দর প্রকৃতি।
রাতে বাসায় ফিরে দুজন ছাদে বসে আছে।
হঠাৎ যূথি বলে কাল আমি চলে যাবো পাপা কল দিয়েছিলো।
ঠিক আছে।
আমাকে মিস করবে না?
নাহ।
যুথি দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বলে আচ্ছা আমি জানতে চেয়েছিলাম তোমার বাবা মা কোথায়।
এক কথায় উত্তর দিচ্ছি দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করো না।
ওকে।
আমার যখন ৭ বছর বয়স মা তখন মারা যায়।বাবা UK চলে যায় তার ঠিক পাঁচ বছর পর।ওখানে সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।এখন তিনি আমাকে মাসে মাসে খরচ দেন।আর সপ্তাহে একবার কল দিয়ে দরদ দেখিয়ে বলে বাবা কেমন আছিস।
যূথি অনেকক্ষণ আর কোনো কথা বলেনি আসলে ও হয়তো বুঝতেই পারছিলো না এখানে কি বলা উচিত।
অনেকক্ষণ পরে যূথি দীর্ঘশ্বাস টেনে বলে শুভ্র তুমি কি এভাবেই থাকবা?
এভাবে কিভাবে?
এই যে চাকরি করো না ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়াও তোমার কি ইচ্ছা করে না স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে?
আমি তোহ স্বাভাবিক জীবন যাপনই করি।আর বাকি রইলো চাকরির কথা।আমার চাকরির কোনো ইচ্ছা নেই।
কিন্তু দেখো শুভ্র চাকরিটা জরুরি তোমার আর্ট তোমার জীবন চালিয়ে দেবে না শুভ্র।আজ তোমার বাবা আছে কাল যখন সে থাকবে না তখন কিভাবে চলবা?
যূথি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখো তোহ একজন মানুষের কত খরচ হয় ভালোভাবে চলতে!
আহামরি তেমন খরচ কিন্তু হয় না।আমরা বড় বড় চাকরি করি টাকা রোজগার করি সমাজে নাম কেনার জন্য।আমি রোজগার করার পরেও দিন শেষে কিন্তু কিছুই আমার না।তোমার বাবা রোজগার করে তোমাদের জন্য নিজের জন্য তার কিছুই না।কিন্তু আমি শুভ্র বাঁচি আমার জন্য।জীবনে আমরা পরিবারের জন্য অনেক কিছুই করি নিজের জন্য কি করি!
এতোসবের ভেতর কিছু তোহ একটা থাক যা একান্ত ব্যক্তিগত যা আমার মানসিক প্রশান্তি কারণ।
যূথি এতোটুকু বুঝে গেছে শুভ্রকে যুক্তি দেখিয়ে লাভ নেই।
ও নিজেকে কখনোই বদলাবে না।
পর দিন সকালে চলে গেলো যূথি চোখ ভরা স্থির অশ্রু নিয়ে।
শুভ্র তেমন ভার্সিটিতে ক্লাস করতো না ভার্সিটিতে গেলেও কখনো যূথির সাথে দেখা করেনি।যূথি চেষ্টা করেও শুভ্রের নাগাল পাইনি।
যূথি চলে যাবার পর শুভ্র মাসে একবার যূথিকে কল দিতো,দিয়ে জিজ্ঞেস করতো যূথি তুমি কেমন আছো।ওপাশ থেকে উত্তরটা ভালো আছি আসলেই শুভ্র কলটা কেটে ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে নিজের রাজ্যকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে যেতো।
সেই একাকী পথ চলা রংতুলি আর সিগারেট।
আমি শুভ্র জগতের কোনো-
মায়া আমাকে কাবু করে রাখতে পারে না।
আমি অনেক বছর কাঁদিনি,আমি হাসিনি বহুদিন।
আমার জীবনে শূণ্যতা বলে কিছু নেই।
আমার জীবনে আছে বিশালতা,আছে আমার আমি।
আমি বোহেমিয়ান শুভ্র।
তাতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই।
(সমাপ্তি)
আপনার ফেসবুক আইডি থেকে কমেন্ট করুন