বোহেমিয়ানঃ ১ম পর্ব
লেখা: ফারজানা সাদিয়া অনন্যা
ছিপছিপে গড়নের বাবরি চুলওয়ালা ২২/২৩বছর বয়সী এক যুবক টং দোকানে বসে সিগারেট ফুঁকছে।
শহরের ট্রাফিক জ্যাম ছেড়ে যুথি গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বার হয়েছিলো,হঠাৎ ছেলেটিকে দেখে গাড়ি থামায়।
পাক্কা ২০ মিনিট ছেলেটির দিকে চেয়ে চেয়ে যুথি কি যেন একটা শান্তি পাচ্ছে।
ছেলেটির চোখেমুখে তার বাবড়ি চুলগুলো এসে পড়ছে।
বারবার মাথা ঝাকিয়ে চুলগুলো পেছনে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
যুথি গাড়ি ছেড়ে নেমে টং দোকানের দিকে এগিয়ে যায়।
মামা একটা দুধ চা দিয়েন চিনি কম।
যুথি ছেলেটির সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আপনার পাশে বসা যাবে?
জ্বি বসুন যদি আপনার সিগারেটের ধোঁয়ায় অসুবিধা না থাকে তবে।
আর যদি অসুবিধা থাকে আমি উঠে যাচ্ছি।
না না বসেই থাকুন সমস্যা নেই।
হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা কালো রঙের হেয়ার ব্যান্ড বার করে যুথি ছেলেটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,এটা দিয়ে চুলগুলো বেঁধে নিন।
ছেলেটি মুচকি হেসে বলে আমি এভাবেই অভ্যস্ত এটার প্রয়োজন নেই ধন্যবাদ।
দোকানী চা দিয়ে গেলে চায়ে ঠোঁট ডুবালো যুথি,কয়েক মিনিট ওদের ভেতর আর কথা হলো না।
পাশে একটা সুন্দরী মেয়ে বসে আছে সে নিয়ে যেনো ছেলেটির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
শুভ্রের এই দিয়ে চার নম্বর সিগারেট চলছে।
আপনি কি সিগারেটের প্রতি অনেক বেশি আসক্ত?
নাহ,তবে যখন ভালো লাগে না এই দোকানটাই বসে সিগারেট টানতে ভালো লাগে।
যুথি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,আমি যুথি।আপনি?
ছেলেটা ইতস্তত হয়ে কয়েকটা আঙুলের মাথা এগিয়ে হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে বলে আমি শুভ্র।
সুন্দর নাম।
ধন্যবাদ।
চা শেষ করে যুথি বলে ওঠে আচ্ছা কখন থেকে আমিই প্রশ্ন করে যাচ্ছি আপনি তোহ কিছু জিজ্ঞেস করলেন না?
আচ্ছা আমাকেও বুঝি প্রশ্ন করতে হবে?
না ঠিক তা নয়।তবে একা একটা মেয়েকে দেখলে মানুষের সাধারণত কৌতূহল হয়।
আচ্ছা।তবে আমার মনে হয় নারী কুলের ওপর যতই কম আগ্রহ দেখানো যায় ততই মঙ্গল।নারী কুল বড়ই অদ্ভুত এদেরকে বোঝা মুশকিল।
আর সবচেয়ে বড় কথা আপনার একাকিত্বের সুযোগ নেওয়ার কোনো আগ্রহ আমার নেই।
যুথি নিজের রাগটা ঢেকে বলে আচ্ছা।শুনুন আমি এখানে ঘুরতে এসেছি।আমাকে একটা হোটেলের ঠিকানা দিতে পারবেন?
এটা তোহ পর্যটক এলাকা নয়।আর এই গ্রামের ভেতর কোনো হোটেল আপাতত নাই।
আপাতত নাই মানে!
মানে এখন নাই ভবিষ্যতে হতেও পারে।
এখন আমি কি করবো!সন্ধ্যা তোহ লেগে গেলো প্রায়।
বিপদে মানুষকে সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।তাই আপনার আপত্তি না থাকলে আমার বাসায় যেতে পারেন।
তবে বাসায় আমি একাই থাকি সকালে একজন চাচা আসেন ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে দিয়ে চলে যান।
যুথি যেনো মনে মনে এটাই চাই ছিলো।
আমার আপত্তি নেই চলুন।একটা আশ্রয় মিললো এটাই অনেক।
গাড়িতে উঠে যুথি শুভ্রকে জিজ্ঞেস করে,আচ্ছা আপনার মা বাবা আপনার সাথে থাকে না?
শুভ্র মৃদু হেসে উত্তর দেয় নাহ।
কেনো?
শুভ্র উত্তর দিলো না।শুধু বললো কিছু প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া ভালো।তাহলে প্রশ্নকর্তা উৎসুক হয়ে বার বা জিজ্ঞেস করবে,না হলে যে উত্তর প্রাপ্তির জন্য অন্য কোনো রাস্তা খুঁজবে।বা উত্তর না পেয়ে সেটা নিয়ে ভাবতে থাকবে।
অন্তহীন এক ভাবনা যে ভাবনার শেষ নেই।অতঃপর সে নিজেই একটা কাহিনী তৈরি করে ফেলবে মনে মনে।
আসলে আমরা পরবর্তী কাহিনী নিজের মন মতো করে গড়ি আমাদের সাময়িক প্রশান্তির জন্য।সত্য হোক বা মিথ্যা প্রশান্তি মিলছে কিনা সেটাই আসল।
মানুষকে ভাবনায় ফেলতে আমার কিন্তু বেশ লাগে।
আরেহ এখানেই থামুন বাসা চলে এসেছে।
এমন এক গ্রামে দোতলা বাসা দেখে যুথি কিছুটা অবাকই হলো।এই বাড়ি আপনার?
জ্বি না।
তাহলে এটা কার বাড়ি?
আমার বাবার বাড়ি ইহ জন্মে আমি কিছুই করতে পারি নাই,না বাড়ি না গাড়ি।
আর করতে পারবো বলে মনে হয় না।ইচ্ছাও নেই,ভেতরে চলুন।
আচ্ছা আপনি এমন অদ্ভুত কেনো?
আচ্ছা কেনো বলুন তোহ!আমার কি দুটো শিং আছে?
উফফ… ভেতরে নিয়ে চলেন আমি খুবই টায়ার্ড।
যুথি ভেতরে গিয়ে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখছে।পুরো বাড়িতেই দেওয়াল চিত্র।সাথে নানা রকমের বাঁশ বেত আর মাটির শৌখিন জিনিসপত্র।দেখে বোঝাই যাচ্ছে আঁকা আঁকির শখ আছে ছেলেটির।
কি দেখছেন!
নাহ কিছু না।কোন রুমে থাকবো?
শুভ্র উপরের দক্ষিণমুখী দুইটা রুমের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে ওই দুইটা রুম আমার।একটাই আমি থাকি আরেকটাতে আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র।বাড়িতে মোট ছয়টা রুম আছে উপর নীচ দিয়ে।ঐ দুইটা রুম বাদ দিয়ে যেকোনো একটা বেছে নিতে পারেন আমার আপত্তি নেই।
যুথি কি যেনো ভেবে পশ্চিমের রুমটা বেঁছে নিলো।
ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখে।বাড়িতে কোনো টিভি নেই।আছে বিশাল একটা লাইব্রেরি।
আর একটা থিয়েটার রুম আছে যেখানে একটা প্রজেক্টর সেট করা,সামনে দুই সিটের একটা সোফা।
রাত নয়টায় ডাক পড়লো যুথির।খেতে আসুন ম্যাম রাত নয়টা বাজে।
এসব দেখতে দেখতে যুথি প্রায় সময় জ্ঞান হারিয়েই ফেলেছিলো।কখন নয়টা বেজে গেছে ঠিকই পায়নি।শীতের রাত নয়টা মানে অনেক রাত।
খাবার টেবিলে বসে দেখে শুভ্র দুই রকমের ভাজি ডাল আর মাছ রান্না করেছে।মাটির পাত্রে পরিবেশন করে রেখেছে সব।সুন্দর রুচিসম্মত মাটির পাত্র আর খাওয়া জন্য দিয়েছে মাটির শানকি।
চাল চলন দেখেই মনে হয় শৈল্পিক মনা একজন মানুষ তিনি।
হাজার সাধারণের মাঝে অসাধারণ কেউ।
দেখুন হঠাৎ এসেছেন আপনি,এর থেকে বেশি আয়োজন আমি করতে পারিনি।আপাতত এই দিয়েই ডিনারটা সেরে নিন।চলবে তোহ?
হুম চলবে।
আচ্ছা আপনি কি করেন?
খাই দাই ঘুরে বেড়ায় মন চাইলে আকাশের নীচে কাটিয়ে দিই দিন রাত।মন চাইলে এই বিশাল অট্টালিকার ছাদের নীচে প্রহর গুনি।
মানে ঠিক বুঝলাম না।
মানে বুঝে আপনার কাজ নেই।আপনি খাওয়া শেষ করে আপনার ঘরে যান।কিছু লাগলে বলবেন।
যুথি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে আপনি আঁকাআঁকি করেন নাকি!
জ্বি করি টুকটাক।
সুন্দর আঁকেন,দেখে যেনো মনে হয় জীবন্ত।
ধন্যবাদ।
রাতে খাওয়া শেষে যুথি ঘরে চলে যায়।
আজ রাতে চাঁদটা ভীষণ আলো ছড়াচ্ছে নাহ জানালা দিয়ে চাঁদ দেখে আশ মিটে না।
শুভ্র একটা সবুজ পাঞ্জাবী গায়ে একটা শাল আর ব্রাউন রঙের চটি জুতা পরে বার হয়ে যায়।
যুথির মনে সন্দেহ বাসা বাঁধে ব্যাটা জাদুকর নাকি রাত বারোটায় একটা মানুষের বাইরে কি কাজ থাকতে পারে!
শুভ্রের পিছু নেয় যুথি।
বাড়ি থেকে বা দিকে জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়ে পাহাড়ে ঘেরা সুনসান জায়গায় এসে শুভ্রের পা জোড়া থামে।
পকেট থেকে সিগারেট বার করে মুখে নিয়ে এক টান দিয়ে বলে।
ম্যাম আমি জানি আপনি আমার পিছু নিয়েছেন।লুকিয়ে দেখে এই জায়গার স্বাদ আপনি পাবেন না…
চলবে…
ভুল ত্রুটি মার্জনা করিবেন।
আপনার ফেসবুক আইডি থেকে কমেন্ট করুন