ষোড়শীতে পা রাখতে না রাখতেই প্রথম ভালোলাগার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েছিলো রাহনুমা। সে কি ভালোলাগা। অন্তরচক্ষুর প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে গেঁথে রেখেছিল তার উপস্থিতি। নিজেকে আড়ষ্ট করেছিল তার মধ্যেই, নানান সাজে নিবিষ্ট করেছিলো তার অবাধ অচতুর মননকে। কতই না ভেবেছিলো রাহনুমা, হায় কি অবাধ্য হৃদয়? দশম শ্রেণীতে বেঞ্চের প্রথম সারিতে বসতো তারা। এরা ছিলো চতুর্ভুজি চক্র। একজন সম্প্রতি মর্ডান জগতের প্রখ্যাত নায়িকাদের ন্যায় চলনবলন এর নাম এলিমা রয়। আর একজন গিটারিস্ট জিনিয়া।
তৃতীয় ব্যক্তিটি রাহনুমার ধাঁচের অর্থাৎ সেই কলি যুগের মানসিকতা সম্পন্ন তার নাম সাবিহা। আর রাহনুমার ডাক নাম রানু এই চক্রের মধ্যে সবাই বেশ সুদর্শীনি। রানু উচ্চতায় পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্বি চুলগুলো ঘেমকালো কোমরের পশ্চাদ্ভাগ পর্যন্ত। শীর্ণ দেহ, ত্রিশূলী চাহনি, সম্মুখভাগে মানানসই লম্বাটে নাক, দেহের বর্ণ শ্যামলা। আর সবচেয়ে আকৃষ্ট করার মত হলো ঔষ্ঠ্যের ডানদিকে নিচের কাজল কালো তিল। এক দেখাতে যে কারোর মনে তরঙ্গ খেলে যাবে নির্দ্বিধায় বলা যায়। এলিমা, জিনিয়া, সাবিহা প্রত্যেকের নামধারী বয়ফ্রেন্ড আছে। এরা স্কুলে বেশ সুপরিচিতা এ ব্যাপারে। তবে রানুর কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। তাকে যে কোনো ছেলে প্রপোজ করেনি এমনটা না মূলত ছেলেদের প্রতি কোনো রকম দূর্বলতা ছিলো না তার অনিহা ছিলো বরাবরই।
পড়াশুনায় ফোকাসটা তার মাত্রারিক্ত ছিলো। বাবা- মার বাধ্য সন্তানের মত বরাবর ভালো রেজাল্ট এনে দিয়েছে তাদের । অবসরে একাডেমিক পড়া ছাড়াও রুচিশীল কিছু বই পড়ার অভ্যাসটা যেন তার অতিরিক্ত। আড্ডাতে যখন তারা তিন জন একে অপরের বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে বলাবলি করতো ঠিক তখন তাদের কথায় অমনোযোগী হয়ে বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় নিজের মনোযোগ কুড়াতো। এজন্য এলিমা কতবার বলেছে, – তুই আসলেই একটা বোরিং। জীবনের ইতিটা বই পড়েই টান। একটাবার প্রেম করেই দেখনা জীবনটা কতটা রোমাঞ্চকর, কতটা রঙিন, কতটা উপভোগ্য। জিনিয়া বলে, – হেই রানু, এখন অবসরেও তো লাইফ নিয়ে কিছু ভাবতে পারিস, তোর পেছনে ঘুরঘুর করা ডেসিং ডেসিং ছেলেদের নিয়ে মজা নিতে পারিস। কাম অন রানু, প্রেম জীবনের অনেক বড় কিছু। সাবিহা বলে, – দেখ রানু বই পড়ার পেছনেও আরও একটা বাস্তব জীবন আছে। এটাকেও তোর প্রধান্য দেওয়া উচিত।
আর জানিস জীবনে সঙ্গী থাকলে জীবনটা অনেক রঙিন হয়, সহজ হয়। এসব কথা কখনো গায়ে মাখেনি রানু। সে স্কুলের ছুটি কিংবা পিকনিকে গেলে আড্ডার ছলে কখনো সময়গুলোকে নষ্ট করে নি তার অন্য বান্ধবীদের মত। সে প্রকৃতির রুপ, রসকে তার মধ্যে সঞ্চিত করে নিজেকে পরিপূর্ণ করতে পছন্দ করে। তার কখনো খারাপ সময়গুলোতে জিনিয়ার থেকে শেখা গিটারের দু এক টা কট ধরে নিজেকে হারিয়ে ফেলার অভ্যাসটা অনেক আগে থেকেই । অনেক সময় নিজে নিজে টুং টাং করে নিজের তৈরি খন্ড খন্ড কটগুলোকে প্রকৃতির মাঝে ছুঁড়ে দিয়েছে। তার কাছে, গিটারের টুং টাং শব্দে প্রকৃতি নিঃশব্দে তার সাথে সুরের যে বহিঃপ্রকাশ ঘটায় ছন্দের তাল মেলায় তাই প্রেম। এর জন্য বয়ফ্রেন্ড নামক উদ্ভট ঝামেলা কে পোহায়?
প্রেমে যে তার বান্ধবীরা নিয়ম করে হলেও দিনে হাজার বার ঝগড়া করে তারপর বাংলার পাঁচের মত মুখ করে বসে থাকে, এরপর ন্যাকামো করে প্রেমিকের মান ভাঙায় এর মধ্যে আবার রঙিন জীবনের কি আছে এটাই রানু ভেবে কুল পায় না। এমন মানসিকতাকে ধরে রেখেছে ষোড়শীর আগে। ষোড়শীতে পা রাখতে না রাখতে হঠাৎ ক্লাসের ছয়ফুট উচ্চতায় প্রতাপ নামের এক ক্যাবলাকান্তের চোখে চোখ পরে রানুর। এক প্রকার অনিহার দৃষ্টি ছিলো প্রতাপের উপর। পড়াশুনায় একেবারে ডাব্বা প্রকৃতির, কাজকামে অকর্মণ্য, দিনের চব্বিশঘণ্টার ষোল ঘন্টায় ঘুমায়। প্রচন্ড গরম কালেও দু চার দিন টানা গোসল না করেও দিন পার করে অনায়েসে। এমন এক যবুথবু মানুষকে যে কখন ভালো লেগে গেলো রানুর সেটা বলার মত কোনো ইতিহাস নেই। প্রতাপ যখন ক্লাস রুমে ঢুকে তার মাঝারি সাইজের খাড়া চুল গুলোর দিকে রানু চেয়ে থাকে। কান পেতে থাকে পায়ের রেওয়াজে।
হৃদকম্পন দ্রুত থেকে দ্রততর হয়। চোখ লজ্জায় নুয়ে পরে। তার চুলে মায়ার এক অপশক্তি আছে। রুমে ঢুকেই তার হাত দিয়ে যখন চুলটাকে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মনে হয় সকালের চকচকা শিশির বিন্দুর ন্যায় দু এক ফোটা পানি টপটপ করে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। ভালোলাগার শুরুর অধ্যায় এখান থেকেই যদিও নিজেকে, নিজের দৃষ্টিকে অনেকবার সামলেছে সে কিন্তু পুরোপুরি তা পারেনি। অথচ কতশত ডেসিং ছেলের লাইন লাগতো তার পেছনে কিন্তু তার মন পড়ে ছিলো ক্যাবলাকান্তের পেছনে। ‘ আসলে ভালোলাগা এক অদ্ভুত জিনিস, যাকে একবার ভালোলাগে তার বদ অভ্যাসগুলোও ভালোলাগার লিস্টে চলে আসে’ রানুর ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটলো। প্রতাপের কথা বলার ধরন, তাকানোর ভঙ্গি এমনকি সিগারেট খাবার স্টাইলটাও মনে গেঁথে গেলো তার। বাম হাতের উপর ডান হাত রেখে মুষ্টিবদ্ধ করে বৃদ্ধা আঙুলের ফাঁকে সিগারেটটা রেখে সিগারেট টান দেবার ভঙ্গিটা যেন অন্যদের থেকে আলাদা রানুর চোখে।
অথচ সিগারেট নামক শব্দতে রানুর গা ঘিনঘিন করে। বেঞ্চের প্রথম সারিতে বসে চোখে প্রেমের খেলায় মেতেছে রানু । কল্পনায় কতশত প্রেমের রঙ্গমহল সাজিয়েছে সবটায় টের পেয়েছে প্রতাপ। কেননা ‘মনের ভাষা চোখে ফুটে উঠে। ভালোবাসার ছাপ তো আরও ভাসমান। তা তো আরও লুকোনোর নয়।’ সেই সাথে এলিমা, জিনিয়া, সাবিহা তারাও রানুর ভাবভঙ্গি আড়িপেতে দেখতো। অনেক সময় ফলো করতো যে তাদের সন্দেহ ঠিক কিনা। কিন্তু রানুর সামনে প্রতাপের কথা বলার দুঃসাহসিকতা কারোর ছিলো না। সময়ের পর সময় যায় রানুর মধ্যে পরিবর্তন সে নিজেই খেয়াল করে। প্রতাপ আর তার চাহনির সংঘর্ষে রানুর দৃষ্টি শক্তিকে লজ্জারা দখল করে ফেলে। এমন চোখাচোখির সংঘর্ষ যে কত বার ঘটেছে তার হিসেব করলে খাতার পাতা ফুরোবে। এখন রানু নিজেই ভাবে সে নিরর্থক প্রেমে পরলো না তো। তা না হলে সে শত চেষ্টাতেও নিজেকে সরাতে পারে না কেন।
এ কেমন মায়া জাল! তাহলে এটাই কি প্রেম? প্রেম না হলে কল্পনায় এত রং পাখা মেলে কিভাবে? না দেখলে অস্থিরতার মানে কি? মন বারবার তার নামের পিছু ছোটে কেন? তাহলে এটাই কি ভালোবাসা ? প্রতাপ রানুর চাহনিতে যদিও কিছু আঁচ করতে পারতো তবু কখনো আগবাড়িয়ে কিছু বলে নি যদি সব ভুলভাল হয়।প্রতাপ রানুর চাহনিতে যদিও কিছু আঁচ করতে পারতো তবু কখনো আগবাড়িয়ে কিছু বলে নি যদি সব ভুলভাল হয়।
এমনিতেই সে উদ্ভট ছেলে। অস্বাভাবিক, জাতেও পাগল তালেও পাগল। তাই সে নিজের মত চুপচুপ থাকতে পছন্দ করে।তাছাড়া তার নামে রটনার ও অভাব ছিলো না। এক দিন তো লিজা নামের মেয়েটার সাথে দেখে নিয়েছিলো রানু। সেদিনের পর থেকে প্রতাপকে রানু একেবারে ঘৃণার চোখে দেখে। তারপর যখন আরও কয়েকটা এমন ঘটনা শুনলো তার ঘৃণাটা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। ঘৃণা বাড়লে কি হবে তার ঘৃণার মাঝেও যে এক প্রকার ভালোবাসার বীজ নিহিত ছিলো তা রানু ঠিকই বুঝতো। আসলে’ ভালোবাসা হলো একটা সমুদ্র আর ঘৃণা হলো তার গভীরতা। ভালোবাসা না থাকলে ঘৃণার গভীরতা থাকে না।’
এরপর দশম শ্রেণীর ফাইনাল সামনে আসলো। রানু নিজেকে বিভিন্ন পন্থায় সংযত করে। প্রতাপের সামনে অব্ধি যায় না। তার থেকে দুরে থাকে এভাবে দশম শ্রেণীর পরীক্ষাটা দিয়ে নিলো। আর সবার থেকে ভালো রেজাল্ট করলো রানু। সবাই খুব খুশি, নামিদামি প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হবার জন্য প্রস্তুতি চলছিলো কিন্তু এর মাঝেও প্রতাপের কথা তার মনের পাশ কাটতে পারেনি। এভাবে ষোড়শী থেকে অষ্টাদশীতে পা রাখলো রানু।
কতশত গুণে ভরা ছেলেরা রানুর মন পারায় এন্ট্রি নেবার প্রচেষ্টা করেছে রানু তা কখনোও গায়ে মাখেনি। তখনও প্রতাপকে রানু ভুলতে পারে নি। যতই ক্যাবলাকান্ত হোক না কেন তারপরই তার ব্যক্তিত্ব সবার থেকে আলাদা। রানুর সেই অনুভব, প্রেম দৃষ্টি শুধুমাত্র প্রতাপের জন্য। বাপারটা হলো, জীবনে প্রথম ভালোলাগাকে ভুলে যাওয়া এত সহজ নয়। ‘ এরপর কোনো এক বিকেলে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রানু বই পড়ছিলো। বই পড়ার ফাঁকে চোখ গেলো রাস্তার দিকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো স্কুল পড়ুয়া প্রতাপের সাথে দেখতে পাওয়া সেই লিজা নামের মেয়েটি। আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে।
বেশ মোটাসোটা, আগের মত আর স্টাইলিস চেহারা নেই, পাশেই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। রানু তাকে দেখেই আর লোভ সামলাতে না পেরে দৌড় দিলো। দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে হাফাতে হাফাতে লিজা বলে ডাক দিলো। লিজা পেছন ফিরে দেখে রানু। এরপর লিজা বলে, – এই তুমি রানু না। দৌড়াচ্ছ কেন? পরে যাবে তো? – হাফাতে, হাফতে হুম আমি রানু। তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো। এই জন্যই দৌড়াচ্ছি।
আচ্ছা তোমার পাশে ছেলেটা কে? – এই ওকে চেন না। ওতো আমার বর। সেই তিন বছর ধরে আমরা রিলেশন করতাম। এই এক বছর হলো বিয়ে করছি। তুমি জানো না? – কই না তো। আচ্ছা তুমি না প্রতাপের গার্লফ্রেন্ড ছিলা? – একটু হেসে, আরে কি বলো। সেই দিন তো আমাদের দুজনের ব্রেকআপ হয়েই যাচ্ছিলো তাই আমি প্রতাপ ভাইয়ার কাছে গেছিলাম সবটা সামলাতে। – ওহ্ তার মানে আমি ভুল ভাবছিলাম রানু মনে মনে বিড়বিড় করে বলে।
আচ্ছা লিজা অনেক ভালো লাগলো তোমার সাথে দেখা হয়ে। এই সামনেই আমার বাড়ি চলো যাই। – আজ না রানু। অনেক দেরি হয়ে গেছে অন্যদিন আসবো। তোমার আর প্রতাপের বিয়েতে দাওয়াত করো। – মানে, আমার আর প্রতাপের বিয়ে কিভাবে বুঝলাম না? – আরে প্রতাপ ভাইয়া তো সেই দু বছর আগে তোমার কথাই শুধু বলতো। ভাইয়া নাকি শুধু তোমাকেই বিয়ে করবে। আর তোমাকে অনেক ভালোবাসতো। – তাহলে আমাকে বলেনি কেন? – ভাইয়া বলতো তুমি নাকি নিজে থেকে আগে বলবে। আচ্ছা রানু গাড়ি এসে গেছে আজ যাই আবার একদিন দেখা হবে, বাই। – ওকে বাই। ভালো থেকো। রানুর মনটা ভীষণ ভার হলো।প্রতাপও তাকে ভালোবাসতো অথচ সেও তাকে প্রকাশ করে নি।
আবার রাগও করলো একটা মেয়ের ভালোবাসি বলার অপেক্ষায় থাকবে কেন ছেলেটা। সে কি বোঝে না মেয়েরা লজ্জা পায়। এদের মনের ভাষা মুখে আনতে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। রানু আনমনা হয়ে ভাবতে থাকে আজ যদি প্রেমকে গুপ্ত না রাখতো তাহলে তারা একে অন্যর ভালোবাসার আবেশে জড়িয়ে থাকতো। ভবিষ্যৎ এ দুজন অর্ধবয়স্ক প্রেমিক প্রমিকা পড়ন্ত বিকেলে বেলগুনিতে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনে মনে বলতো, – আজও আমাদের ভালোবাসাটা গুপ্তই থাক।…………
আপনার ফেসবুক আইডি থেকে কমেন্ট করুন